শাহ অলীউল্লাহ লেহলভী তার মশহুর গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বলিগায়ে হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে,
হুজুর (সা:) থেকে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা সাধারণত দু’প্রকার।
১) যাতে তার নবুয়ত ও রেসালাতের দায়িত্ব সম্পর্কীয় বিষয়াদি বর্ণিত হয়েছে।
যেমন যে সব হাদীসে পরকালীন জীবনের বিভিন্ন বিষয়াদি ও অবস্থা এবং উর্ধ্ব জগতের অভিনব অবস্থানসমূহের বর্ণনা দান করা হয়েছে।
এ ধরনের হাদীসসমূহের উৎস একমাত্র অহী। আর এই প্রকারের হাদীসের ব্যাপারেই আল্লাহ নিম্নরূপ নির্দেশ দিয়েছেন।
“রাসূল (সা:) তোমাদেরকে যা কিছু নির্দেশ করেন তা মেনে নাও। আর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।”
শরীয়তের বিধি-বিধান, ইবাদতের নিয়ম-প্রণালী এবং এমন সব জন-কল্যাণমূলক বিধিবিধান যা সুধূর প্রসারী এবং যা জন্য কোন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
এ ধরনের হাদীসও ১ম পর্যায়ভুক্ত। তবে এর কিছু অংশ অহীর সূত্রে প্রাপ্ত এবং কিছু অংশ স্বয়ং রাসূলের ইজতেহাদ।
অবশ্য নবী কারীমের ইজতেহাদও অহীর সম-মর্যাদা সম্পন্ন। কেননা নবীর ইজতেহাদ কখনও ভুলের পরে স্থায়ী হতে পারে না।
আমলসমূহের ফজিলত, আমলকারীদের গুণ ও মর্যাদা সম্পর্কীয় হাদীসও প্রথম শ্রেণিভুক্ত। আমার মতে এর অধিকাংশই অহীসূত্রে প্রাপ্ত।
আর কিছু কিছু অংশ হুজুরের ইজতিহাদের ফলশ্রুতি।
২) যাতে হুজুরের নবুয়ত ও রেসালাতের দায়িত্বের বিষয়াদি বর্ণনা করা হয়নি বরং অন্যান্য বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে।
যেমন চাষাবাদ ও জীবজন্তুর গুণাগুণ সম্পর্কীয় কথাবার্তা। যেমন হুজুর (সা:) বলেছেন, তোমরা সাদা কপোল বিশিষ্ট গাঢ় কালো রঙের ঘোরা রাখবে।
অনুরূপ যে সব হাদীসে এমন সব কাজের বর্ণা আছে যা হুজুর অভ্যাস বশত করেছেন, ইবাদতরূপে নহে এগুলোও দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত।
বৈষয়িক ও কারিগরি ব্যাপারে হুজুরের আলাপ-আলোচনাও এই পর্যায়ের।
এর মধ্যে কোনটির উৎস অভিজ্ঞতা, কোনটির উৎস দেশ প্রথা ও অভ্যাস, আবার কোনটির উৎস সাক্ষ প্রমাণ।
এর সবগুলো আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নহে, তবে অনুকরণীয়।
হাদীসের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে মুহাদ্দেসীনের মত হলো নিম্নরূপ:
রাসূল কারীমের (সা:) মহান সত্তাই হলো হাদীস শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়। অর্থাৎ হুজুর নবীর পদ মর্যাদায় থেকে নবী হিসেবে যা কিছু করেছেন,
বলেছেন এবং করার অনুমিত দিয়েছেন,আর এর মাধ্যমে হুজুরের যেসব মহান সত্তা রাসূল হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠেছে তাই হাদীসের আলোচ্য বিষয়।
হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হল রাসূলের আহকাম ও দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের তাৎপর্য অনুধাবন করে উভয় জাহানের কল্যাণ লাভ করা।
“উমদাতুলকারী” গ্রন্থে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন:
“উভয় জাহানের পরম কল্যাণ লাভই হচ্ছে হাদীস অধ্যয়নের স্বার্থকতা।”
সুন্নত
সুন্নত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি।
আর হাদীসের পরিভাষায় সুন্নত বলা হয় সেই পথ ও মতকে যে পথ ও মত অবলম্বন করে হুজুর (সা:) চলতেন।
এটা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রচলিত সুন্নত নয়। ইমাম রাগেব তার “মুফারাদাত” নামক গ্রন্থে লিখেছেন:
” যে পথ ও নিয়ম পদ্দতিকে নবী কারীম (সা:) বাছাই করে নিতেন তাকে-ই সুন্নত বলা হয়।”
আল্লামা ইব্রাহীম ইবনে মুসা সরনাতি তার মশহুর কিতাব “আল-মুয়াস্ফাকাতে” লিখেছেন, নবী কারীম (সা:) থেকে বর্ণিত ও প্রমাণিত বিষয়াদিকেই সুন্নত বলা হয়।
বিশেষ করে যে সব বিষয়ে কোরআনে স্পষ্ট কোন হুকুম নেই। বরং নবী কারীমই কেবল সে সব বিষয়ে স্বীয় মতামত ও নির্দেশ ইত্যাদি দিয়েছন।
কখনও কখনও সুন্নত বিদয়াতের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়।
যেমন বলা হয় অমুক সুন্নতের প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন তার কাজ কর্ম রাসূলের কাজ-কর্মের অনুরূপ হয়।
(সে কাজ-কর্মের পরিষ্কার বর্ণনা কোরআনে থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু আসে যায় না।)
আবার বলা হয় অমুক ব্যক্তি বিদয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন তার কাজ কর্ম সুন্নতের বিপরীত হয়। এখানে হুজুরের আমলকেই সুন্নত বলা হয়েছে।
সুন্নত শব্দের ব্যবহার সাহাবীদের আমলের উপরো হয়ে থাকে। কেননা একথা সর্বসম্মত যে সাহাবায়ে কেরাম প্রমাণ্য সুন্নতেরঈ অনুসরণ করেছেন।
আল্লামা আব্দুল আজীজ তার “তাওযীহুন্নজর” নামক কিতাবে সুন্নতের নিম্নরূপ পরিচয় দিয়েছেন :
“সুন্নত শব্দ যেমন রাসূলের কথা ও কাজের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় রাসূল ও সাহাবীদের অনুসৃত নীতি ও কর্ম-পদ্দতি ব্যাপারে।”
কখনও কখবও সুন্নতকে শুধু হাদীসের অর্থেও ব্যবহার করা হয়।